রাজশাহীর কারাগারে ‘আয়নাবাজি’: আসামি বাইরে কারাগারে সাজা খাটছে অন্যজন

স্টাফ রিপোর্টার : চেক জালিয়াতি মামলায় কারাদণ্ড হয়েছে সেতাউর রহমানের (৩৯)। কিন্তু সেতাউর সেজে কারাগারে সাজা খাটছেন মো. মিঠুন (৩২)। অমিতাভ রেজার বাংলা থ্রিলার সিনেমা ‘আয়নাবাজি’র মতো চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। একটি রিকশা আর কিছু টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মাদকসেবী মিঠুনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সেতাউর।

সেতাউরের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামে। তিনি কানসাট ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য। শিবগঞ্জে তাঁর বেকারি কারখানা রয়েছে। মিঠুনের বাড়িও বিশ্বনাথপুর গ্রামে। গত আড়াই মাস ধরে তিনি সেতাউরের হয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।

মামলার নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর বায়া এলাকার এফএম অটোরাইস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার মিলের স্বত্বাধিকারী মো. আজিজ ৭০ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির অভিযোগে সেতাউর রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। গত বছরের ১৮ এপ্রিল রাজশাহীর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ-১ আদালতের বিচারক মোছা. রুবিনা পারভীন ওই মামলার রায়ে তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি তাঁকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

মামলার রায় ঘোষণার সময় আসামি সেতাউর পলাতক ছিলেন। এরপর গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিঠুনকে আসামি সাজিয়ে রাজশাহীর আদালতে আত্মসমর্পণ করানো হয়। আদালতকে মিঠুন তাঁর নাম জানান সেতাউর। পরে আদালত তাঁকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। আর বাইরে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়ান মূল আসামি সেতাউর রহমান।

এদিকে সেতাউরের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার টাকার চেক জালিয়াতির অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি মামলা করেছিলেন আবদুল মালেক নামের এক ব্যক্তি। আবদুল মালেক নিজেই একজন আইনজীবী। তাঁর মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছিলেন সেতাউর। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সেতাউর তাঁর টাকা পরিশোধ করেননি। ফলে আবদুল মালেক বিষয়টি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুগ্ম দায়রা জজ আদালত-২-এর নজরে আনেন।

সম্প্রতি তিনি আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিরও আবেদন করেন। আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে শিবগঞ্জ থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠান। পরবর্তীকালে আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় আইনজীবী আবদুল মালেক শিবগঞ্জ থানায় যান। তখন পুলিশ তাঁকে জানায়, মালেকের মামলার আসামি অন্য আরেক মামলায় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী।

এতে সন্দেহ হয় আইনজীবী মালেকের। তিনি কারাগারে থাকা আসামিকে আদালতে হাজির করার জন্য আবেদন জানান। সে অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদালতে আসামি সেতাউর হিসেবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিঠুনকে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ সময় আইনজীবী আবদুল মালেক আইনজীবীকে জানান, এই আসামি সেতাউর নয়। তিনি অন্য কেউ। এ সময় মিঠুনও আদালতে স্বীকার করেন যে তিনি সেতাউর নন। টাকার লোভে তিনি সেতাউর সেজে কারাগারে গেছিলেন। কিন্তু সেতাউর তাঁকে শুধু কারাগারের পিসি বইতে ছয় হাজার টাকা দিয়েছেন। আর কোনো টাকা দেওয়া হয়নি।

আইনজীবী আবদুল মালেক বলেন, ‘আদালত নিশ্চিত হয়েছেন যে অন্য মামলায় সেতাউর সেজে মিঠুন কারাগারে জেল খাটছেন। এ কারণে তাঁকে আমার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। মিঠুনকে আবার কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখনো কারাগারে।’

মিঠুনের স্ত্রী আশা খাতুন জানান, তাঁর স্বামী মাদকাসক্ত। স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজ নেন না। তাই তিনি বাবার বাড়িতে থাকেন। তিনি শুনেছিলেন, তাঁর স্বামী কারাগারে আছেন। কিন্তু কোন মামলায় তা জানতেন না। বৃহস্পতিবার জেনেছেন, সেতাউর সেজে তিনি কারাগারে। তিনি স্বামীর সঙ্গে দেখা করেছেন। মিঠুন এ সময় তাঁকে বলেন, কারাগারে থাকলে মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে সেতাউর তাঁকে এখানে পাঠিয়েছে। কিছুদিন পর তাঁকে বের করা হবে। কারাগারে নিয়মিত টাকা দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কারাগার থেকে বের হলে একটি রিকশা দেওয়ার লোভও তাঁর স্বামীকে দেখান সেতাউর।

আশা বলেন, ‘এখন আমার স্বামী বলছে, তাঁর ভুল হয়ে গেছে। তাকে যেন বের করার ব্যবস্থা করি। আমি মামলার বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সবকিছু বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন, মামলার আগামী ধার্য তারিখে তিনি বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন। তখন আমার স্বামী বের হতে পারে।’

আশা খাতুন আরও বলেন, ‘সেতাউরের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, আমি যেন এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা না বলি। যেন চুপচাপ থাকি।’

বৃহস্পতিবার দুপুরে সেতাউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে দাবি করেন, এটি সেতাউরের নম্বর নয়। তিনি নিজের নাম সবুজ দাবি করেন। নম্বরটি নিশ্চিত হয়েই ফোন করা হয়েছে জানালে কথা বলার জন্য তিনি পাঁচ মিনিট সময় নেন। তিন মিনিট পর তিনি ফোন ব্যাক করে বলেন, ‘ভাই, আমি এসব কিছুই জানি না। আমার মামলায় কে জেলে গেছে সেটাও আমি বলতে পারব না। আমার নামে দু-তিনটা মামলা ছিল, শেষ হয়ে গেছে।’

রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আলী আশরাফ মাসুম বলেন, ‘যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে মিঠুনকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি সেতাউর নন। তা না হলে তাঁর মুক্তি নেই। যদি স্বেচ্ছায় টাকার বিনিময়ে মিঠুন কারাগারে যান তাহলে তিনি নিজেই অপরাধী। যে ব্যক্তি পাঠিয়েছেন তিনিও অপরাধী।’

আইনজীবী আলী আশরাফ মাসুম আরও বলেন, ‘যে আইনজীবীর মাধ্যমে মিঠুন সেতাউর সেজে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাঁর মিঠুনকে চেনার কথা নয়। তারপরও বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে এলে আদালত তাঁকেও কারণ দর্শাতে পারেন। কারণ, এগুলো যেমন অপরাধ তেমনি একজন ব্যক্তির মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com